“চাঁদপুর এর ইতিহাস সংস্কৃতি ঐতিহ্য ”
রিয়াজ শাওন
বাংলাদেশ ৬৪ জেলার একটি জেলা হল চাঁদপুর। সৃষ্টিকর্তা সুনিপুণ ইশারায় গড়া অপরুপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি চাঁদপুর জেলা। শিক্ষা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সব দিক থেকে চাঁদপুর জেলা একটি পরিপূর্ণ উপন্যাস। জ্ঞানী গুনী আওলিয়া দরবেশ ফকির সহ অনেক বিশিষ্ট ব্যাক্তির জম্ম চাঁদপুর জেলায়। ইতিহাস ঐতিহ্য সাংস্কৃতিক নিয়ে ষোলঅনাই পরিপূর্ণ। পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্হলে এ জেলা অবস্থিত। চাঁদপুরের মানুষ আতিথেয়তার জন্য বিখ্যাত। ইলিশ মাছের অন্যতম প্রজনন অঞ্চল হিসেবে চাঁদপুরকে “ইলিশের বাড়ি ” নামে ডাকা হয়।
১৭৭৯ খ্রি. ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজি জরিপকারী মেজর জেমস্ রেনেল তৎকালীন বাংলার যে মানচিত্র এঁকেছিলেন তাতে চাঁদপুর নামে এক অখ্যাত জনপদ ছিল। তখন চাঁদপুরের দক্ষিণে নরসিংহপুর নামক (যা বর্তমানে নদীগর্ভে বিলীন) স্থানে চাঁদপুরের অফিস-আদালত ছিল। পদ্মা ও মেঘনার সঙ্গমস্থল ছিল বর্তমান স্থান হতে প্রায় ৬০ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে। মেঘনা নদীর ভাঙ্গাগড়ার খেলায় এ এলাকা বর্তমানে বিলীন হয়েছে। বার ভূঁইয়াদের আমলে চাঁদপুর অঞ্চল বিক্রমপুরের জমিদার চাঁদরায়ের দখলে ছিল। এ অঞ্চলে তিনি একটি শাসনকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। ঐতিহাসিক জে. এম. সেনগুপ্তের মতে, চাঁদরায়ের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম হয়েছে চাঁদপুর। অন্যমতে, চাঁদপুর শহরের (কোড়ালিয়া) পুরিন্দপুর মহল্লার চাঁদ ফকিরের নাম অনুসারে এ অঞ্চলের নাম চাঁদপুর। কারো মতে, শাহ আহমেদ চাঁদ নামে একজন প্রশাসক দিল্লী থেকে পঞ্চদশ শতকে এখানে এসে একটি নদীবন্দর স্থাপন করেছিলেন। তার নামানুসারে নাম হয়েছে চাঁদপুর। তিনি বাস করতেন পুরিন্দপুর এলাকায়। হাজীগঞ্জের ফিরোজশাহী মসজিদ মুসলিম স্থাপত্য কীর্তির অন্যতম নিদর্শন। যেটি ফখরুদ্দীন মোবারক শাহের দেওয়ান ফিরোজখান লস্কর নির্মাণ করেছেন বলে শিলালিপি থেকে জানা যায়। হাজীগঞ্জ উপজেলাধীন অলিপুর গ্রামে প্রখ্যাত মোঘল শাসক আব্দুল্লাহর প্রশাসনিক সদর দপ্তর ছিল। এখানে রয়েছে বাদশাহ আলমগীরের নামাঙ্কিত বিখ্যাত আলমগীরি পাঁচগম্বুজ মসজিদ, শাহাজাদা সুজা স্থাপিত তিনগম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ। মোঘল আমলের বীর সেনানায়কদের শানবাঁধানো মাজার। বর্তমানে অলিদের মাজার নামে খ্যাত। ব্রিটিশ আমলে প্রশাসনিক পূর্ণবিন্যাসের ফলে ১৮৭৮ সালে প্রথম চাঁদপুর মহকুমার সৃষ্টি হয়। ১৮৯৬ সালের ১ অক্টোবর চাঁদপুর শহরকে পৌরসভা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৮৪ সালে ১৫ ফেব্রুয়ারি চাঁদপুর জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় চাঁদপুর ২নং সেক্টরের অধীনে ছিল। ১৯৭১ সালের ১২ মে পাকবাহিনী হাজীগঞ্জ উপজেলার কাশিমপুর গ্রামের ৫০ জন লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করে এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। এ গণহত্যার পর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালালে পাকবাহিনীর ১৭ জন সৈন্য নিহত এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। শাহরাস্তি উপজেলার নাওড়া, সূচীপাড়া এবং উনকিলার পূর্বাংশে বেলপুরের কাছে মিত্র বাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর সংঘর্ষে মিত্র বাহিনীর ১৩ জন সৈন্য এবং পাকবাহিনীর ৩৫ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় মতলব উত্তর উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়।
চাঁদপুরকে দেশ-বিদেশে বিশেষভাবে উপস্থাপনের জন্য ২০১৫ সালের আগস্ট মাস হতে জেলা ব্র্যান্ডিং কার্যক্রম শুরু করেন তৎকালিন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আব্দুস সবুর মণ্ডল। ইলিশের সাথে সামঞ্জস্য রেখে এর ব্র্যান্ডিং নাম দেন ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর । ২০১৭ সালে দেশের প্রথম ব্র্যান্ডিং জেলা হিসেবে চাঁদপুরকে স্বীকৃতি দেয়।
চাঁদপুর জেলার আয়তন ১৭৪০৬ বর্গকিলোমিটারের। জনসংখ্যা ২০১১ সালের হিসেব অনুযায়ী ২৬০০২৬৩ জন প্রায়। জনসংখ্যার ঘনত্ন ১৫২৬ জন প্রতি কিলোমিটারে। এখানে বসবাসরত্ব জনসংখ্যার ৯৩.৫৪% মুসলিম হিন্দু ৬.৩৮% আর বৌদ্ধ ০.০৮%।
চাঁদপুর জেলায় গঠিত হয় ৮ টি উপজেলা, ৮ টি থানা,৭ টি পৌরসভা,৮৯ টি ইউনিয়ন, ১০৪১ টি মৌজা, ১৩৬৫ টি গ্রাম এবং ৫ টি সংসদীয় আসন নিয়ে।
চাঁদপুর জেলায় শিক্ষার হার ৬৯.৮ %। এখানে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হলঃ
মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ২৫০,প্রাথমিক বিদ্যালয় ১১২০ টি, মাদ্রাসা: ১,২৫৭টি,১টি চাঁদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট,১ টি মেরিন একাডেমি, ১ টি মেডিকেল কলেজ। সরকারি কলেজ ৭ টি, বেসরকারি কলেজ ৪৫ টি রয়েছে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশে চাঁদপুরে বুক দিয়ে বয়ে চলে ৮ টি নদী। পদ্মা মেঘনা ডাকাতিয়া গোমতী ধানগোদা মতলব নদী উধামধী চারাতভোগ নদী গুলো প্রতিনিয়ত বয়েই চলছে আপন গতীতে।
আশীর্বাদপূষ্ঠ্য এই নদীগুলোর কারনে
চাঁদপুর জেলার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। নদী তীরবর্তী এলাকা বলে প্রায় ৩০% মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য শিল্পের সাথে জড়িত। এছাড়াও উল্লেখযোগ্যভাবে অনেক ব্যবসায়ী বিদ্যমান। জেলা সদরে অনেক মাছের আড়ত রয়েছে, যা জেলার অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। চাঁদপুর শহরের বাবুরহাটে বড়বড় বহু শিল্পকারখানা রয়েছে। এই জায়গাটিকে সরকার বিসিক শিল্প নগরী ঘোষণা করে। এই এলাকাটি শুধু চাঁদপুরের নয় পুরো বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি আশীর্বাদস্বরূপ শিল্প নগরী। মেঘনার ভাঙ্গনে প্রতি বছর চাঁদপুরের আয়তন কমে গেলেও মেঘনা, চাঁদপুরের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। প্রতি বর্ষায় পানিতে ডুবে যায়, ফলে বর্ষাকালে চাঁদপুর মাছের মাতৃভূমি হয়ে যায়। জেলার প্রধান শস্য ধান, পাট, গম, আখ। রপ্তানী পণ্যের মধ্যে রয়েছে নারিকেল, চিংড়ি, আলু, ইলিশ মাছ, সবুজ শাক-সবজি, বিসিক নগরীর তৈরি পোশাক শিল্প।
চাঁদপুর জেলায় রয়েছে অনেক দর্শনীয় স্থান যা চাঁদপুরবাসীর পদচারণ মূখরিত থাকে সব সময়।
অঙ্গীকার স্মৃতিসৌধ,ইলিশ চত্বর,ওনুয়া স্মৃতি ভাস্কর্য,কড়ৈতলী জমিদার বাড়ি,গুরুর চর,চৌধুরী বাড়ি,তুলাতুলী মঠ
,দুর্লভ জাতের নাগলিঙ্গম গাছ (জেলা প্রশাসক বাংলো),নাওড়া মঠ,পর্তুগীজ দুর্গ, সাহেবগঞ্জ
ফাইভ স্টার পার্ক,
বখতিয়ার খান মসজিদ (কচুয়া),বলাখাল জমিদার বাড়ি,বড়কুল জমিদার বাড়ি (ভাগ্যিতা বাড়ি),বড়স্টেশন মোলহেড নদীর মোহনা (চাঁদপুর সদর),বোটানিকাল গার্ডেন,বোয়ালিয়া, জমিদার বাড়ি,মঠখোলার মঠ,মনসা মুড়া (কচুয়া),মত্স্য জাদুঘর,মেঘনা নদীর তীর (মতলব),মেঘনা-পদ্মার চর,রক্তধারা স্মৃতিসৌধ
রাগৈ মুঘল আমলের ৩ গম্বুজ মসজিদ
রামচন্দ্রপুর বড় পাটওয়ারী বাড়ী (ডাকাতিয়া নদী সংলগ্ন),রূপসা জমিদার বাড়ি
লোহাগড় জমিদার বাড়ি,লোহাগড় মঠ,লুধুয়া,জমিদার বাড়ি,গজরা জমিদার বাড়ি,শপথ চত্বর,শহীদ রাজু ভাস্কর্য,শিশু পার্ক,সাচার রথ (কচুয়া),সাহাপুর রাজবাড়ি
হযরত শাহরাস্তি (রহ.) এর মাজার
হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ (৬ষ্ঠ বৃহত্তম),আলমগীরী মসজিদ,শাহ সুজা মসজিদ,৫০০ বছরের পুরাতন মসজিদ, মিনি কক্সবাজার সহ অনেক জায়গা।
আর দশর্নাথীদের জন্য রয়েছে চাঁদপুর জেলার রয়েছে কিছু ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় এবং সুপরিচিত খাদ্য। ইলিশ মাছ যার স্বাদে গন্ধে যে কোন খাদকপ্রিয় মানুষকে আকৃষ্ট করে পেলবে অনায়াসেই। অন্য দিকে চাঁদপুরের ওয়ান মিনিট এবং ফরিদগঞ্জ এর আউয়ালের মিষ্টি কথা দেশে বিদেশে সব জাগায় শুনা যায়।
পরিশেষ বলা যায় অপরুপ সৌন্দর্যের নয়ারম লীলাভূমি চাঁদপুর জেলা। দাঁড়িয়ে আছে নিজেশ
ইতিহাস সংস্কৃতি ঐতিহ্যর ভিত্তির উপর।
“ইলিশে ভরপুর, আমাদের চাঁদপুর
চাঁদপুর যাবি তোরা ইলিশ খাবি
চাঁদপুর হইলো ইলিশের বাড়ি”
লেখকঃ রিয়াজ শাওন
বিতর্কীক,চাঁদপুর সরকারি কলেজ